টাকা যেভাবে আসলো পৃথিবীতে
টাকা আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ , টাকা ছাড়া আজকের পৃথিবীতে এক পা চলাও যথেষ্ট দুঃসাধ্য ব্যাপার। কিন্তু টাকাতো কোনাে অমূল্য বস্তু নয় বরং বিনিময়ের একটি মাধ্যম মাত্র।
কোথা থেকে মানুষ শিখলো তবে অর্থের ব্যবহার, কোন পদ্ধতি দিয়েই বা টাকারূপী অর্থের মানদণ্ড নির্ধারণ হয়?
‘অর্থই নাকি সব অনর্থের মূল, আবার অর্থ ছাড়া জগৎ ব্যাকুল’!
তাহলে পৃথিবীতে টাকা কিভাবে আসলো, অর্থের বিবর্তন হয় আবার কিভাবে? সেইসাথে আগামী দিনের লিকুইড মানিটা আসলে কি? আজকের ভিডিওতে টাকার আদি থেকে ভবিষ্যতের এসব নিয়ে আলােচনা করব যেখানে আরো থাকছে লিকুইড মানির প্রভাবে কি রকম হতে পারে ভবিষ্যত দুনিয়া….
বন্ধুরা, পরিবর্তনই জগতের চিরন্তন নিয়ম। টাকাও সেই নিয়মের বাইরের কিছু নয় তাই একে একে টাকার বিভিন্ন সময়ের অবস্থান এবং প্রাচীন বিনিময় প্রথা থেকে বর্তমান কাগুজে মুদ্রা ব্যবস্থা সম্পর্কে দেখে নেওয়া যাক আগে।
★ ৬০০০ খ্রীস্টপূর্বে মানব জগতের সভ্যতার চাকা যখন ঘুরতে শুরু করেছে তখন থেকেই লেনদেনের প্রয়ােজন মানুষ বুঝতে শিখে গেছে, কিন্তু তখন লেনদেনের কোনাে নির্দিষ্ট মাধ্যম ছিল না। নির্দিষ্ট বস্তু বা পরিষেবার বদলে অন্য কোনাে বস্তু বা পরিষেবার বিনিময় বা আদান প্রদান চলত মূলত। যে জিনিসগুলি সাধারণত বিনিময় প্রথায় ব্যবহৃত হত সেগুলো হলো খাদ্যশস্য, গবাদি পশু, এবং অস্ত্র।
★ তো বন্ধুরা, সেই বিনিময় প্রথায় কিন্তু বেশ ঝামেলা ছিল; প্রথম সমস্যা ছিল মানের তুলনা করা, ধরেন কোনাে একজন চাইল দশ বস্তা খাদ্য শস্যের বিনিময়ে একটি গবাদি পশু দিতে, অপরদিকে অন্য ব্যক্তিটি মনে করলাে দশ নয় ওই পশুর জন্য আট বস্তা শস্যই দেওয়া যাবে।
তখন আট বস্তা না দশ বস্তা কোনটা পশুর সমমানের তা নির্দিষ্ট করার কোনাে উপায় ছিল ।
★তারপর ৬০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দের আশেপাশে যে অঞ্চলে প্রথম ধাতুর মুদ্রার প্রচলন শুরু হয় তা বর্তমানের তুরস্কে অন্তর্গত একটি অংশ। এই মুদ্রাগুলি ছিল সােনা ও রুপা মিশ্রিত। দর্শক টার্কিরাই মূলত প্রথম অর্থকে একটি বাহ্যিক রূপ প্রদান করে।
★অপরদিকে চীনারা মুদ্রা হিসেবে অস্ত্রের ছােট আকারের প্রতিরূপ বানাতে শুরু করে ব্রোঞ্জ দিয়ে।
কিন্তু দুঃখের বিষয় ছােটো ছােটো তীর, ধনুক, ছুরি ইত্যাদি সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়ানাে মােটেই সুখকর ছিল না, তাই এই সব আকার আকৃতি বাদ দিয়ে শুধুমাত্র গােলাকার বস্তুগুলিই গ্রহণযােগ্য হয়ে উঠল অর্থ হিসেবে।
★ধাতুর মুদ্রা ব্যবহারের সুবিধা ছিল এই যে একই ধরণের ধাতুর ক্ষেত্রে মানের ফারাক নিয়ে সমস্যা হতাে না আর পরিবহনের সুবিধাও অনেক।
সহজেই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়। তো বন্ধুরা বিশ্বব্যাপী এভাবেই তখনকার অর্থ ব্যবস্থা একটি নির্দিষ্ট স্ট্যান্ডার্ডে আসে।
সােনা, রুপা ও তামা প্রভৃতি ধাতু অনুযায়ী মুদ্রার মূল্যও আলাদা হতাে। এছাড়াও দরকার মতাে এই ধাতুগুলি গলিয়ে অন্য বস্তুও বানিয়ে নেওয়া যেত।
★ বন্ধুরা,আমাদের সমাজে সবার পছন্দ বা অপছন্দ বেশ আলাদা তো বিভিন্ন জায়গায় মুদ্রার ক্ষেত্রেও আকৃতি বিভিন্ন হতাে এবং কেউ সােনাকে বেশি দামি মনে করতাে আবার কোনাে দেশে রুপার গুরুত্ব ছিল বেশি।
সার্বিক বিবেচনায় এরপর সােনা ও রুপা দুইয়েরই ঢালাইকৃত মুদ্রার প্রচলন শুরু হয়, এগুলাের ওজন, পুরুতা ও ধাতুর পরিমাণ সমমানের করা হত। এরপর বিভিন্ন দেশ একই মুদ্রায় লেনদেন শুরু হয়। স্বর্ণ- রূপাকে কারেন্সী বিবেচনায় তখনকার সময়ে এভাবেই চলতে থাকে বিশ্ব মুদ্রাব্যবস্থা।
★কাগজের টাকার ইতিহাস – প্রায় ৭০০ খ্রীস্টাব্দে তাং রাজবংশের আমলে চিনে সোনা-রূপার মুদ্রার পরিবর্তে কাগজের টাকার প্রচলন আরম্ভ হলেও তা বেশিদিন স্থায়ী ছিলনা।
তো এইভাবেই পৃথিবীর একেক প্রান্তে একেক অর্থ ব্যবস্থা আবর্তিত হতে থাকে, যার সম্পূর্ণ প্রেক্ষাপট বদলে যায় ১৯ শতকের শুরুর দিকেই।
বর্তমান সময়ের আধুনিক আমেরিকান সিস্টেমের মুদ্রা ব্যবস্থা বুঝতে হলে টাকা ও কারেন্সির মধ্যে তফাৎ কি, সেটা জানতে হবে আগে….
গাইজ, অর্থ বা টাকা আসলে অর্থনৈতিক চাকাকে সচল ও চাঙা রাখার একটি মাধ্যম, প্রকৃত অর্থে এসব টাকাকে ধরা বা ছোঁয়া সম্ভবই নয়। কাগজের নােট বা কয়েন এই সবই আসলে কারেন্সি, শুধুমাত্র স্বর্ণের বিপরীতে নির্দিষ্ট মূল্যামান যোগ করে টাকাকে একটি বাহ্যিক রূপ দেওয়া হয়েছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আটলান্টিকের অপর পাশে থাকা আমেরিকান ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে প্রচুর পরিমাণ স্বর্ণ বৃদ্ধি পেতে থাকে এমনকি বর্তমানেও তাদের দেশের রিজার্ভে সর্বাধিক স্বর্ণ রয়েছে। স্বর্ণের মজুদে সেরা হওয়ার দরুন বিশ্বব্যাপী টাকার মূল্যমান নির্ধারিত হয় ডলারের দামের কথা মাথায় রেখেই, বন্ধুরা বুঝতেই পারছো যে সামগ্রিক অর্থ ব্যবস্থাকে কুক্ষিগত করে সেখান থেকেই আমেরিকানরা তাবৎ দুনিয়ার মোড়ল হয়ে উঠে….
দর্শক এতোক্ষণ তো টাকার বিভিন্ন রকম বিবর্তন দেখলেন, হালের ক্রিপ্টোকারেন্সী বা আমাদের দেশের বিকাশ বা নগদে আমরা যে অর্থ আদান-প্রদান করি তাইই কিন্তু ভবিষ্যৎ মুদ্রা ব্যবস্থা হতে চলেছে। এই ইলেকট্রনিক মানি বা অদৃশ্য অর্থ ব্যবস্থাই মূলত লিকুইড মানি।
তো এই লিকুইড মানির প্রভাব কেমন হতে পারে ভবিষ্যতে?
★বিশ্বের বহুদেশে অনলাইন বিকিকিনির জন্য লিকুইড মানি এরই মধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে যেখানে উইকিপিডিয়া, ওয়ার্ডপ্রেস, মাইক্রোসফটের মত প্রায় ৩০ হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠান এইসব ইলেকট্রনিক মানি গ্রহণ করে চলেছে বেশ কিছু বছর আগে থেকেই।
★উন্নত বিশ্বের বহু দেশেই এরইমধ্যে রাস্তার পাশে রাখা বুথ থেকে লিকুইড মানির সাহায্য মানুষ বিভিন্ন পণ্য ক্রয় করছে।
★লিকুইড মানির মূল্য দিন দিন বেড়েই চলেছে। এত মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ হিসেব বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এটি খনন করার জন্য শক্তিশালী কম্পিউটার ও সার্ভার প্রয়োজন সাথে রয়েছে বিদ্যুৎ খরচ।
★বিটকয়েন আবিষ্কারের পর ক্রিপ্টোকারেন্সির প্রতি সবার আগ্রহ আকাশসম হয়ে যায়। অনেক প্রযুক্তিবিদ এবং অর্থনীতিবিদ বলছেন, ইন্টারনেট যেমন মিডিয়া জগতে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে, ঠিক তেমনি অর্থশাস্ত্র এবং অর্থনীতিতে ক্রিপ্টোকারেন্সি বিপ্লব ঘটাতে যাচ্ছে।
★আপনারা হয়তো এরই মধ্যে আচ করতে পেরেছেন, লিকুইড মানির ব্যবহার এত সুদূরপ্রসারীভাবে হচ্ছে যে ভবিষ্যতে হয়তো কাগজের টাকার আর কোনো অস্তিত্বই থাকবে না, গবেষণা অন্তত সেটাই বলছে।
লিকুইড মানিটা কোন বিবর্তনে মানব সমাজে প্রবেশ করলো তাহলে?
আশির দশকের শুরুতে আমেরিকায় ব্যাংক ভিত্তিক এটিএম কার্ডের যাত্রা শুরু হয়, যা দিয়ে তৎকালীন সময়ে বার, ড্যান্স শো প্লাটফর্ম গুলোয় বিল পরিশোধ করা যেতো, তখন এই কার্ড খুব দ্রুতবেগে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এরপর ১৯৯০ এর পর থেকে ইন্টারনেট এর বদৌলতে অনলাইন লেনদেন ধীরে ধীরে আরো জনপ্রিয় হতে থাকে।
অনলাইনে সরাসরি টাকার লেনদেনের শুরু,
১৯৯৮ সালে Confinity নামের একটি সংস্থা ২০০০ সালে X ডটকম নামের অপর একটি আর্থিক লেনদেনকারী সংস্থার সাথে জুড়ে গিয়ে সৃষ্টি হয় বিখ্যাত কোম্পানি Paypal এর।
অনলাইন হােক বা নগদে লেনদেন এই সব ক্ষেত্রেই কিন্তু মধ্যবর্তী কোনাে প্রতিষ্ঠান যেমন – ব্যাঙ্ক অর্থাৎ কোনাে মিডলম্যান এর প্রয়ােজন হত যে কিনা এটা সুনিশ্চিত করতাে যে একই টাকা কোনােভাবেই লেনদেনের ক্ষেত্রে একবারের বেশি না ব্যবহৃত হয় এবং এই মধ্যবর্তী সংস্থাকে জনগণের বিশ্বাস অর্জন করতে হতাে।
তো বন্ধুরা, এতোক্ষনের আলোচনা থেকে বোঝা গেল অর্থনৈতিক লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে এখন যে টাকা ব্যবহার করা হয় তা কিন্তু একদিনে আসেনি। প্রথমে পণ্য-দ্রব্যের মাধ্যমে লেনদেন শুরু এরপর আসে কয়েন, তারপর আসে কাগজের নোট, এরপর কার্ড দিয়ে লেনদেন শুরু হয়। এমনকি বর্তমান সময়ে মোবাইল ওয়ালেটের মাধ্যমে টাকাকে স্পর্শ না করেই লেনদেন করা যাচ্ছে, বর্তমানে সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে এই ক্রিপ্টোকারেন্সি বা লিকুইড মানি।
যেভাবে বিভিন্ন দেশে লিকুইড মানির গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে তাতে করে আগামী এক যুগের মধ্যে হয়তো কাগজের নোটের অস্তিত্ব আমরা আর না-ও দেখতে পারি। নতুন লেনদেনের এই মাধ্যমকে উন্নত দেশগুলো ভালোভাবেই স্বাগত জানিয়েছে।
এরকমটি হলে কেনাকাটা, জমি এবং সম্পদ বণ্টন ও জমা পদ্ধতি, ব্যবসা ইত্যাদি ক্ষেত্রে যে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
বিভিন্ন সময়ে টাকার বাহ্যিক রূপের পরিবর্তন হলেও লেনদেন করার জন্য টাকার যে গুণ থাকা চাই সেটা কিন্তু যুগযুগ ধরে অপরিবর্তিত আছে।
এখন বাকিটা দেখার বিষয় যে কীভাবে লিকুইড মানি কাগজের টাকার পুরোটা অংশ দখল করে নেয়।