BusinessTechWorld

গিনেস বুক অফ রেকর্ড যেভাবে ইনকাম করে

সৃষ্টির শুরু থেকে মানুষের মধ্যে অজানাকে জানার কৌতূহল কাজ করে আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় বিশ্বের ক্ষুদ্রতম, বৃহত্তম, দীর্ঘতম, দ্রুততম এসব বিষয়ে মানুষের জানার আগ্রহ এবং নতুন কিছু করে দেখানোর আগ্রহ বৃদ্ধি পেতে থাকে। আর বিশেষ এই ক্যাটাগরী গুলো বিশদভাবে লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়েছে যে বইয়ে সেটিই গিনেস বুক। এককথায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে রেকর্ড সৃষ্টিকারী ঘটনা গুলো নিয়ে লেখা বই গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস,যার শুরুটা হয়েছিল বিয়ার কোম্পানির স্পন্সর ও নামে। এখন কথা হলো বিশ্ব সমাদৃত গিনেস ওয়ার্ল্ড বুক এই সংস্থাটি কারা চালায়?কীভাবে শুরু এই বই-এর যাত্রা- গিনেস কর্তৃপক্ষের ইনকামের খাত গুলোই বা কি কি? অতীত বর্তমানের ইতিহাস ঘেটে নেয়া তথ্য থেকে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের সবই জানতে পারবেন আমাদের আজকের ভিডিওতে।

রেকর্ড গড়া রেকর্ডসের এই বইটির জন্ম হয়েছিল আজ থেকে ৬৭ বছর আগে, এরপর থেকে এই বই বিশ্বের সর্বাধিক জনপ্রিয় বিক্রি হওয়া বইয়ে পরিণত হয়। গিনেস বুক অফ রেকর্ডস-এর জনক দুই যমজ ভাই নরিস ও রস ম্যাকওয়ার্টার,তারাই 

প্রথম বইটি সংকলন করেছিলেন। ২৭শে অগাস্ট ১৯৫৫ তে লন্ডন শহরে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল নতুন এই রেফারেন্স বইয়ের প্রথম সংস্করণ। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষুদ্র বস্তু, সবচেয়ে দ্রুত জিনিষ, সবচেয়ে মোটা মানুষ- এমনই সব রেকর্ড তৈরি করা নানা ঘটনার সংকলন ছিল ঐ পুস্তকে।

গিনেস বুকের প্রথম সংস্করণ বের করার জন্য যমজ দুই ভাই একটানা তিন মাস প্রতি সপ্তাহে নব্বই ঘন্টা করে কাজ করেছিলেন। তথ্য-উপাত্ত ঘেটে ১৯৮ পৃষ্ঠার প্রথম গিনেস বুক তারা ৫০ হাজার কপি ছেপেছিলেন। যা তখনকার দিনের তুলনায় ছিল বেশ বড়সড় একটা সংখ্যা। বই বিক্রির দায়িত্বে থাকা লোকটি প্রথম একটা জায়গা থেকে অর্ডার পেয়েছিলেন মাত্র ছয় কপির। এতে তারা কিছুটা হতাশ হলেও তাদের উদ্বেগ কাটিয়ে কয়েক ঘন্টা পরে সেই অর্ডার বেড়ে প্রথমে হল ১০০ কপি, আরো কয়েক ঘন্টা পর আরো এক হাজার কপি। অবাক করে দিয়ে সময় গড়াতে ক্রমেই বাড়তে লাগল তাদের অর্ডার।

গিনেস বুক প্রকাশের ভাবনার শুরু কিন্তু আয়ারল্যান্ডের এক ধনীর বাসভবনে,১৯৫৪ সালের আগস্ট মাসে। ঐ সময় বিত্তবান এবং সমাজের উঁচু মহলের কিছু মানুষ জড়ো হয়েছিলেন পাখি শিকারের যাওয়ার উদ্দেশ্য। তাদের মধ্যে ছিলেন মদ্যপানীয় বিয়ারের এক চোলাইখানার সভাপতি সার হিউ বিভার। আর এই বিখ্যাত ব্যাক্তিরই চোলাইখানার নাম ছিল গিনেস। যাইহোক ধনীদের এই আড্ডার এক ফাঁকে তাদের মধ্যে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়ে গেল ইউরোপের মধ্যে শিকারের উপযোগী সবচেয়ে দ্রুতগতির পাখি কোনটি?

প্রশ্নের জবাব কেউ দিতে না পারার পর গিনেসেরই একজন কর্মচারী সার হিউকে জানান যমজ ভাই নরিস আর রসের কথা। যাদের 

একজন অ্যাথলিট আর অন্যভাই ছিলেন সাংবাদিক। ঐ সময় তারা তথ্যানুসন্ধানের লক্ষ্যে লন্ডনে একটা সংস্থা গড়ে তুলেছিলো।

তথ্য আর পরিসংখ্যান নিয়ে দুই ভাই-ই ছোটবেলা থেকে ছিলেন তুমুল উৎসাহী। ছোট বয়স থেকেই তারা খবরের কাগজ পড়তেন আর কোথাও কোনো আগ্রহব্যঞ্জক তথ্য কিংবা পরিসংখ্যান দেখলে তা কেটে খাতায় লাগিয়ে রাখতেন। কিছু করার ভাবনা তাদের মাথায় এলে দু ভাই একসঙ্গেই করতেন আর দুজনের সম্মিলিত স্মৃতিশক্তি ছিল খুবই প্রখর। 

সার হিউ উৎসাহী দুইভাইকে ঢেকে পাঠালেন তার চোলাইখানায়। তারপর তাদের নানাধরনের প্রশ্ন করলে রীতিমত অবাক করে দিয়ে দুভাই সব প্রশ্নেরই ঠিক-ঠিক জবাব দেয়। সার হিউ খুশিমনে বিয়ার কোম্পানি গিনেস প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তাদের গিনেস রেকর্ডস বই তৈরির কাজ দেন।

পরের বছরই ১৯৫৫ সালের ক্রিসমাসে ব্রিটেনে সর্বাধিক বিক্রি হওয়া বই ছিল গিনেস বুক অফ রেকর্ডস ।ঠিক এক দশক পরেই এই বই বিশ্বের বাজারে হয়ে উঠে অন্যতম বেস্ট সেলার বই। মাঝে ১৯৬২ সালে ফরাসি এবং ১৯৬৩ সালে বইটির র্জামান সংস্করণ প্রকাশিত হয়। আর এভাবেই ২০০০ সালের আগ পর্যন্ত গিনেস বুক অফ রেকর্ডসের মূল ইনকাম ছিল বই বিক্রি হওয়া টাকা থেকে। বর্তমান সময়ে ১০০ টিরও অধিক দেশে ৪০ এরও বেশি ভাষায় মোট ৬৭ টি সংস্করণ বের হয়েছে এই বইটির। এখন পর্যন্ত এর মোট বিক্রিত কপি প্রায় ১৫ কোটি।

১৯৭২ সাল থেকে গিনেস বুকের টেলিকাস্ট হতে থাকে টেলিভিশনে। প্রতিবছর বের হয় বইটির নতুন সংস্করণ। আর ১৯৭৪ সালে প্রায় আড়াই কোটি কপি বিক্রি করে এই বইটি সর্বকালের সর্বোচ্চ বিক্রিত বই হিসেবে নিজেই ওয়ার্ল্ড রেকর্ড করে বসে।২০০৩ সালে গিনেজ তার ১০ কোটিতম সংস্করণ বিক্রি করে।

গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডের মালিকানায় থাকা লোকেরা একসময় মূলত বই বিক্রি করেই অর্থ উপার্জন করতো। কিন্তু ইন্টারনেটের উত্থানের সাথে সাথে বইয়ের বিক্রি হ্রাস পায়। তাই যুগের সাথে তাল মিলিয়ে গিনেস তাদের নতুন একটি ব্যবসায়িক মডেল তৈরি করে সবকিছু ওয়েবসাইট বা অনলাইন সিস্টেম করে ফেলে।

দুই হাজার সালে গিনেস বই তার নাম পরিবর্তন করে গিনেজ বুক অফ রেকর্ডস থেকে হয়ে যায় গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস। সেই বছরই Guinness World Records ডটকম ওয়েবসাইটের যাত্রা শুরু হয়। তার ঠিক পরের বছর ২০০১ সালে প্রথমবারের মতো দিনে গিনেস বুকের মালিকানার পরিবর্তন হয়। বিয়ার কোম্পানি গিনেস তাদের মালিকানা স্বত্ব বিক্রি করে দেয়। এরপর আরো বেশ কয়েকবার গিনেস বুকের মালিকানা স্বত্ব পরিবর্তন হয়ে বর্তমান মালিক HIT এন্টারটেইনমেন্ট ২০০২ সালে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস কিনে নেয় গুলেন এন্টারটেইনমেন্টের কাছ থেকে।

গিনেজে মূলত দুই ধরনের রেকর্ড এর আবেদন করা যায়। হয় আপনাকে পুরাতন রেকর্ড ভাঙতে হবে নয়তো নতুন কোনো রেকর্ড করতে হবে। 

একটি আবেদন সম্পন্ন হয়ে নিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষ হতে প্রায় বারো সপ্তাহ সময় লাগে। কিন্তু কেউ যদি দ্রুততময় সময়ের মধ্যে করতে চায় তাহলে ৮৫ হাজার টাকা বাড়তি গুনতে হবে তাকে, এতে আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে মাত্র ৫ দিনে। তবে কেউ যদি এত টাকা দিয়ে আবেদন করেও পুরাতন রেকর্ড ভাঙতে না পারেন এবং নতুন কোন রেকর্ড করতে না পারেন তাহলে তার রেকর্ড  গিনেস বুকে স্থান পাবে না।

ভাবছেন আমাদের দেশের কোনো রেকর্ড আছে কিনা গিনেসে?

সর্ববৃহৎ মানব পতাকা, দীর্ঘতম মানববন্ধন, লাখো কন্ঠে জাতীয় সংগীত গাওয়া, সর্ববৃহৎ শস্যচিত্র সহ আরো বহু রেকর্ড রয়েছে বাংলাদেশীদের দখলে। মজার ও আশ্চর্য ঘটনাগুলো গিনেসবুকে ঠাই পেলেও, জনকল্যাণমূলক কাজগুলোকেও গিনেস বুক হাইলাইট করে থাকে।

রেকর্ডস বইয়ের ৬৭ বছর হতে চলায় মানুষ এখন কোন বিষয়ে রেকর্ড করবে তা বুঝতে না পেরে সবাই এখন ছুটছে অদ্ভুত সব কাজের দিকে। ভাবনা গুলো কতটা অদ্ভুদ তা আপনারা এখনকার সময়ের এপিসোড গুলো না দেখলে বুঝতে পারবেন না। কারণ হিসেবে বলা যায় বইটি জনপ্রিয় হওয়ার পর সাধারণ মানুষরাই রেকর্ড ভাঙ্গার নানা খবর গিনেসকে দিতে শুরু করে।এরপর বইটি বাজারে যতই জনপ্রিয় হতে লাগল বা যতই এর বিক্রি বাড়তে থাকল, ততই মানুষের মধ্যে নানাধরনের উদ্ভট রেকর্ড তৈরির উৎসাহও বাড়তে থাকে।

গিনেস বুক অফ রেকর্ডস-এর প্রথম সংস্করণের কথা স্মরণ করে নরিসের ছেলে অ্যালেস্টার ম্যাকওয়ার্টার জানান বর্তমান গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস বইয়ের থেকে প্রথম সেই বই ছিল আকারে খুবই ছোট। বইটি ছিল শক্ত বাঁধাইয়ের ভীষণ শক্ত এক সাদামাটা মলাটে ঘেরা। 

দুই শতর চেয়ে কম পাতার বইয়ে রেকর্ড সৃষ্টিকারী ঘটনাগুলো লিপিবদ্ধ করা ছিল বিস্তারিতভাবে- বেশ খানিকটা ঘটনার পটভূমির বর্ণনাসহ।

এছাড়াও”বইতে সেসময় যে ক’টা ছবি ছিল তার সবই মূলত সাদা কালো ছবি। বইটা দেখতে ছিল অনেকটা কাঠখোট্টা টাইপের কিন্তু ঘটনাগুলোর বর্ণনার ভেতরে একটা সহজাত মজার আমেজ ছিল।”

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button