কম্পাউন্ড ইফেক্ট যেভাবে কাজ করে
আচ্ছা বলুনতো,
কোন মানুষের সাকসেস বা ফেইলার হওয়ার পিছনে মূল কারণ হিসেবে কাজ করে কোন ফ্যাক্টর?
তার ছেলেবেলায় সে কিভাবে বড় হয়েছে, তার পরিবেশ নাকি অন্য কিছু?
না এখানে Root Factor হল তার নিজের নেয়া ছোট ছোট চয়েজ এবং পদক্ষেপ।
পৃথিবীতে শুধুমাত্র একটাই জিনিস আছে যেটা আমরা চাইলেই পুরোপুরিভাবে কন্ট্রোল করতে পারি, সেটা হচ্ছে আমাদের চয়েজ। আর এই পছন্দ -অপছন্দ গুলোই আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের আউটকামের জন্য দায়ী।
আপনি যদি ইচ্ছা করেন তাহলে অফিস থেকে ফেরার পর জিমে যেতে পারেন বা সোফাতে শুয়ে টিভিও দেখতে পারেন। প্রিয়তমার সাথে ঝগড়া হওয়ার পর আপনি যদি চান সবকিছু ভুলে তাকে স্বাভাবিক করে নিতেই পারেন অথবা আপনার ইগোকে প্রশ্রয় দিয়ে সেখান থেকে বেড়িয়েও আসতে পারেন। যদিও বলার মতো সবকিছু অতো একেবারে সহজও না..
কিন্তু আমরা এরকম ছোট ছোট পদক্ষেপ গুলোয় বেশি মন দিই না, তাই আজকের এ ভিডিওতে কম্পাউন্ড ইফেক্টের মাধ্যমে দেখানো হবে ছোট ছোট চয়েজ গুলো কিভাবে আমাদের সবকিছুর আউটকাম নির্ধারন করে থাকে। সেইসাথে আরো জানবেন বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে কিভাবে কম টাকাকে কম্পাউন্ড ইফেক্টের মাধ্যমে খুব দ্রুত বাড়ানো যায়। তো চলুন দর্শক শুরু করা যাক…….
কম্পাউন্ড ইফেক্ট আপনার সার্বিক জীবন পরিবর্তন করে দিতে পারে,
ধরুন রাকিব এবং আকিব দুজন বন্ধু। দুজনেরই স্বচ্ছল পরিবার বছরে দুলাখ টাকার মতো রোজগার ছিল, দুজনেরই বিয়ে হয়ে গেছে এবং সবাই মোটামুটি ভাবে জীবন চালিয়ে যাচ্ছিলেন ।
দু বন্ধুর মধ্যে রাকিব জীবনে বড়ো কিছু করতে চাইলেন, সফল হতে চাইলেন তাই তিনি প্রতিদিন শিক্ষামূলক বই পড়তে শুরু করলেন, জীবনে উন্নতি করতে প্রতিদিন ‘মোটিভেশনাল” অডিও/ভিডিও দেখতে শুরু করলেন। স্বাস্থ্যে উন্নতি করতে প্রতিদিন ব্যায়াম শুরু করলেন, স্বাস্থ্যকর খাদ্য খেতে শুরু করলো। ফাস্ট ফুড খাওয়া বন্ধ করে দিল।
অপরদিকে বন্ধু আকিব কোনো ভালো কিছু করার পরিবর্তে খারাপ অভ্যাস শুরু করলেন। যেমন ফাস্টফুড খাওয়ার অভ্যাস চালু করলেন ,প্রত্যেক দিন কাজ করার পরিবর্তে ঘুমিয়ে থাকলেন , প্রতিদিন সময় নষ্ট করে টিভি দেখতে লাগলেন।
এভাবে ছয় মাস পার হয়ে গেলেও দুই জনের খুব একটা পরিবর্তন চোখে পড়েনি, কিন্তু ১ বছর পর খালি চোখেই দেখা গেলো রাকিব ১০ কেজি ওজন কমিয়ে নিয়েছেন। তিনি মাসে ৪টি বই এর হিসাবে বছর এ ৪৮টি বই পড়ে শেষ করেছেন। যার ফলে তাঁর ব্যক্তিত্বের অনেক পরিবর্তন এসেছে, অনেক জ্ঞান বৃদ্ধি হয়েছে এবং তাঁর চাকুরীতে প্রমোশন হয়েছে। স্বাস্থ্যকর খাদ্য খেয়ে তার শরীর সুস্থ হয়েছে। সবশেষে তার জীবন খুশিতে ভরে গেছে।
অন্য দিকে আকিব ফাস্ট ফুড খাওয়ার জন্য তার দেহের ওজন ১০ কেজি বেড়ে গেছে। খারাপ জীবনশৈলীর জন্যে পরিবার এর মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি শুরু হয়েছে। ফলাফলে মানসিক ও শারীরিক অশান্তি।
সাধারণত যেসব জিনিস এ তৎক্ষণাৎ খুশি পাওয়া যায়, আমাদের মন সেটাই করতে চায়। উপরের কাহিনী তে আকিব নগদ আনন্দ পেতে সেই জিনিসটাই করলেন, প্রতিদিন ফাস্টফুড খাওয়া,টিভি দেখা ,ঘুমিয়ে থাকা এসব জিনিস এ তৎক্ষণাৎ খুশি পাওয়া যায় । কিন্তু দীর্ঘদিনের ক্ষেত্রে এগুলো জীবনে বড়ো ক্ষতি নিয়ে আসে।
তাহলে এখানে কম্পাউন্ড ইফেক্টের কি বুঝলেন?
আচ্ছা না বুঝলেেও সমস্যা নেই, চলুন আপনাকে রবি ঠাকুরের একটি কবিতার দু’লাইন শোনাই,
“ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণা বিন্দু বিন্দু জল, গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই কবিতার সাথে কম্পাউন্ড ইফেক্টের কার্যপদ্ধতি সম্পূর্ণ পরিপূরক সাথে সর্বকালের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন “কম্পাউন্ড ইন্টারেস্ট” হচ্ছে পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য।
আরে এইটা আবার কেমন কথা, আপেক্ষিক বিষয় যা দেখা যায়না তা কিভাবে অষ্টম আশ্চর্য হয়?
তাহলে বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী কেন কম্পাউন্ড ইন্টারেস্টকে পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য বলেছিলেন?
কম্পাউন্ড ইফেক্ট এর বহুমাত্রিক ব্যবহার রয়েছে, মানুষ যদি জীবনে ছোট ছোট ভালো অভ্যাস বা আউটপুট ভিত্তিক কাজ ক্রমাগতভাবে করে যেতে থাকে তবে সে কাজ জীবনে একসময় বিশাল কিছু হয়ে আত্মপ্রকাশ করবে। পক্ষান্তরে মানুষ যদি ছোট ছোট ভালো কাজগুলো না করে বা কাজ করা বন্ধ করে দেয় তবে নেগেটিভভাবে বিশাল কিছু হয়ে তা জীবনে আসবে। কম্পাউন্ড ইফেক্ট এর আসল কথাটি হচ্ছে, “Either you earn it or you pay for it”.
বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আয়ের কিছু অংশ পুঁজি হিসাবে অবশ্যই ব্যবহার করা উচিত, যা আপনাকে নতুন আয় দেবে। ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে শুধু মাত্র একটি দিক থেকে আয় নয়, একাধিক দিক দিয়ে থেকে আয় দরকার। আর কম্পাউন্ড ইফেক্ট ব্যবহার জানলে সে আয় হতে পারে কয়েকগুণ বেশী….,তো চলুন এমনই কিছু লাভজনক অর্থ উপার্জনের মাধ্যম সম্বন্ধে জেনে আসি,
১. ফরেক্স ট্রেডঃ
Forex হল Foreign Exchange এর সংক্ষিপ্ত রুপ। এটি একটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা বাজার। এই মার্কেটে বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয় এর মাধ্যমে আয় করা যায়। আপনি যখন একটি দেশের মুদ্রা দিয়ে আরেকটি দেশের মুদ্রা ক্রয় করবেন তখন সেই দেশের মুদ্রার দাম আপনার ক্রয়কৃত দামের ঊর্ধ্বগতির পার্থক্যই হচ্ছে আপনার লাভ।
ভাবতেও পারবেন না এই বাজারটি এত বড় যা নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ মার্কেটের চেয়ে কয়েক গুন বেশি ভলিয়াম এ দেনিক ট্রেড হয়। এখানে দৈনিক টার্ন-অভার এর পরিমান প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন ইউ.এস ডলার এরও বেশি।
বর্তমানে বিশ্বের ১৫-২০ ভাগ মানুষ ফরেক্সকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন, মূলত ফরেক্সও একধরনের আউটসোর্সিং বিজনেস। কম্পাউন্ড ইফেক্টের মাধ্যমে আপনার ইনভেস্ট দিয়ে ফরেক্স ট্রেড করে ১ বছরের আয় মাত্র ১ সপ্তাহেই করতে পারবেন তবে এ ক্ষেত্রে রিস্ক রয়েছে কিন্তু প্রোপার মানি ম্যানেজমেন্ট স্কিল থাকলে খুব একটা বেগ পেতে হবেনা।
২. ব্যাংক ডিপোজিট
যেকোনো ব্যাংকে টাকা জমানোর মেয়াদ কাল হলো ৩ বছর, ৫ বছর , ৭ বছর এবং ১০ বছর।
ব্যাংকে আপনি চাইলে মাসিক কিস্তিতে ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ব্যাংকের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে টাকা জমা রাখতে পারবেন।
ডিপিএস এ ব্যাংক গুলোতে আপনাকে সুদের হার শতকরা ৫%-১০%এবং সঞ্চয় হিসেবে আপনি শতকরা কিছুটা কম সুদ পাবেন। ব্যাংকে টাকা রেখে যদি সুদের চিন্তা মাথায় আসে তাহলে আপনার পছন্দ মতো ইসলামি ব্যাংক গুলোয় ডিপোজিট করে মুনাফা অর্জন করতে পারেন।
কম্পাউন্ড ইফেক্টে আপনার টাকা মূলত যেভাবে বাড়বে, ধরুন আপনি ১০% ইন্টারেস্টে ত্রিশ বছরের জন্য ১০০০ টাকা ইনভেস্ট করতে চাচ্ছেন প্রথম বছর শেষে আপনার লাভ হলো ১০০ টাকা মোট হলো ১০০+১০০০= ১১০০ টাকা, দ্বিতীয় বছরে মোট হচ্ছে ১১০০+১১০= ১২১০ টাকা, তৃতীয় বছরে হবে ১২১০+১২১= ১৩৩১ টাকা এইভাবে কম্পাউন্ড ইন্টারেস্টে ৩০ বছর শেষে হবে ১৭৪৪৯ টাকা।
এই একহাজার টাকা যদি আপনি আবার সাধারণ ইন্টারেস্টে ইনভেস্ট করতেন তাহলে আপনার লাভ হতো মাত্র ৪ হাজার টাকা।
মূল ব্যাপারটাই হলো কম্পাউন্ড ইফেক্টে বছর শেষে আপনার ১০% মুনাফা তুলতে পারবেন না,নির্দিষ্ট সময় শেষে টাকাটা তুলতে হবে, আর সাধারণ নিয়মে প্রতি বছরই আপনার একাউন্ট থেকে মুনাফা তোলার সুযোগ রয়ে যাওয়াতে সেই টাকাটা আর বাড়েনা।
এ থেকেই আশা করি বুঝতে পারছেন কম্পাউন্ড ইফেক্টে সাধারণ নিয়মের চেয়ে ৪-৫ গুণ লাভ অনায়াসে বেশি হয়।
একটা গল্প শোনা যাক তবে কম্পাউন্ড ইফেক্টে আয় বেশী হওয়া নিয়ে,
দাবা খেলার আবিস্কারক প্রথমবার রাজাকে খেলাটা দেখানোর পর রাজার এতো পছন্দ হলো যে, উনি তাঁকে পুরস্কৃত করতে চাইলেন। খেলার আবিস্কারক রাজা মশাই কে বললেন, রাজা মশাই আমাকে বেশি কিছু পুরস্কার দিতে হবে না, শুধু দাবা খেলার বোর্ডে যে ৬৪ টি ঘর আছে তার প্রথম থেকে প্রতিটি ঘরে ধারাবাহিক ভাবে প্রথমটির দ্বিগুন করে চাল এর দানা রাখুন এবং এইভাবে ৬৪তম ঘর পর্যন্ত যে পরিমান মোট সংখ্যা হচ্ছে সেই পরিমান চালের দানা আমাকে দিন।
তারপর রাজার কর্মীরা দাবার প্রথম ঘরে ১টি চালের দানা ; দ্বিতীয়ঘরে ২টি, তৃতীয় ঘরে ৪টি ,চতুর্থতে ৮টি ,পঞ্চম ঘরে ১৬টি,ষষ্ঠ ঘরে ৩২টি , সপ্তম ঘরে ৬৪ টি….. এই ভাবে চলতে থাকল।
কিন্তু মজার বিষয় হলো কিছু ঘর যেতে যেতেই রাজার কর্মীরা বুঝলেন রাজা ফেঁসে গেছেন, ৬৪ তম ঘরে যে পরিমান চাল হবে সেটা যখন হিসাব করে দেখা গেলো, সেই চালের পরিমান হচ্ছে (১৮৪৪৬ ৭৪৪০৭৩৭০৯৫৫১৬১৫) এই সংখ্যাটি। এতগুলো চালের দানার ওজন দাড়ায় ৪৬১ মেট্রিক টন চাল। সংখ্যাটা দেখে মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো না? হায় হায় ব্যাপারটা কি….
এত্তো চাল এখন রাজা পাবে কই? রাজাতো যতারীতি আশ্চর্য হয়ে ওই লোকের পান্ডিত্য এর প্রশংসা করলেন। এটাই হচ্ছে চক্রবৃদ্ধি হরে বৃদ্ধির নিয়ম বা কম্পাউন্ড ইফেক্ট যাকে আমরা “Domino Effect” বলে জানি, যা আপনার রোজগার হওয়া টাকা থেকে আবার নতুন রোজগার নিয়ে আসে।
কম্পাউন্ড ইফেক্টের এই সূত্র ব্যবহার করে আপনি চাইলে আপনার ইনভেস্টের কয়েকশো গুণ অনায়াসেই তুলে আনতে পারেন, প্রয়োজন শুধু ধৈর্য্য এবং সঠিক সিদ্ধান্ত। প্রাথমিক বা শুরুর কিছুদিন হয়তো এতোটা প্রফিট আনতে পারবেন না, কারণ হালাল ইনকামে একটু কষ্ট আছে….😊
এতো বড় উদাহারন টানার অর্থ হলো ছোট কাজই করুন, কিন্তু বুদ্ধিমানের মতো করুন, অবহেলা করে নয় এবং খারাপ অভ্যাস গ্রহণ তো একদমই নয়।
কম্পাউন্ড ইফেক্ট আমাদেরকে এই শিক্ষা দেয় যে, আমরা ব্যাক্তি জীবনে যা প্রত্যাশা করি বা নিজেদের জন্য যে স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করেছি, জীবনে একসময় না একসময় তার প্রাপ্তি ঘটবেই। কিন্তু তার পূর্বে যে আমাদেরকে তৈরি হতে হবে, তার জন্য আমরা কতটুকু যন্ত্রণা বা কষ্ট সহ্য করতে প্রস্তুত আছি?